সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০০৪ সালে। হাটহাজারীর জুবলী গ্রামে তার নিজ বাড়িতে একটি এনজিও প্রোগ্রামে। পরবর্তিতে ২০০৬ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পেলে চীন মৈত্রি সম্মেলন কেন্দ্রে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি হিসাবে তার সংবর্ধনা কভার করেছিলাম কাছে থেকে দেখে। বাংলাদেশে প্রথম নোবল জয়ী! তার সেদিনের বক্তব্য আমার চোখে কেন যেন পানি চলে এসেছিল জানি না। তার সাথে নীতিগতভাবেই কিছু ভিন্নমত আছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋন এর পক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু তার বিশাল ব্যাক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে একজন লেখক ও সংবাদপত্রে কাজের সুবাদে পরবর্তীতে তার বেশ কয়েকবার কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
নোবেল জয়ের পরপরই ইত্তেফাক এর সহযোগী পত্রিকা সাপ্তাহিক রোববার কাভার প্রচ্ছেদ হয় ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে। পুরো একটি সংখ্যাই ছিল ড. ইউনুস। সেখানে তার সাক্ষাৎকার নেয়ার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। আমি ও সাংবাদিক মোরশেদ মোরসালিন সেদিন গ্রামিন ব্যাংক অফিসে তার এসাইনমেন্ট নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে যাই। জীবনের টুকিটাকি সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছিলেন সেদিন তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে। আমরা বুঝতেই পারছিলামনা একজন নোবল জয়ীর সাথে কথা বলছি। তাকে কাছে থেকে জানা ও খোলামেলা কথা বলা এটিই প্রথম বলাচলে।
সেদিন মনখোলা সাক্ষাৎকার নিতে নিতে মনে হয়েছিল, চমৎকার সাদামাটা অমায়িক মানুষ তিনি। সদা হাস্যোজ্জল। নিরহংকার একজন ব্যাক্তিত্ব। গ্রামিন চেক আর বাংলার শিকড়ের সাথে মিশে থাকা একজন বিশ্বজয়ী মনীষা তিনি। আমি বহুভাষাবিদ পন্ডিত লেখক ড.সৈয়দ মুজতবা আলীর পরিবারের সন্তান পরিচয় পেয়ে সেদিন আলাদা খাতির ও আপ্যায়ন করেছিলেন। তৎকালীন জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমাদের পরিবারের কৃতি সন্তান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তখন। আসার সময় চেয়ার থেকে উঠে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
আজ তিনি বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান। যাদেরকে সামনে রেখে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে সেই ছাত্র সমন্বয়কদের প্রস্তাবিত নাম ড. মুহাম্মদ ইউনুস৷ আর যে আন্দোলনের ওপর ভর করে একটু জুলুমের অবসান হলো, সেই ছাত্র আন্দোলনে মূলত দেশের সকল মত আর পথের মানুষ এতে যুক্ত ছিলেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমার কাছে তাদের পছন্দটাকে যথাযথ বলে মনে হয়েছে। কারো সেই পছন্দে ভিন্নমত থাকতে পারে। ধর্মীয় আবেগ এখানে মূখ্য নয়। দেশের ক্লান্তিকালে সংকট উত্তরণ পলিসি মূল বিষয়। এখানে বৈশ্বিক রাজনৈতিক কৌশল আর গনমানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন হওয়া উচিত।
ড. ইউনুস এমন একজন মানুষ যিনি হাসিনা রেজিমের প্রবল রোষের শিকার হয়েছেন। কাজ আর খ্যাতি দিয়ে গোটা দুনিয়ার বাহবা পেলেও, তিনি শেখ হাসিনার দুই চোখের বিষ ছিলেন।
ড. ইউনুস একজন নোবেল লরিয়েট। বিশ্বজোড়া তার খ্যাতি। বাংলাদেশের মতো একটা দারিদ্রপীড়িত দেশের তিন থেকে ছয় মাসের সরকার প্রধান হওয়াটা তার জীবনে উটকো ঝামেলার মতোই ছোটখাটো ব্যাপার বলে মন হয়।
এই মুহুর্তে শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন না এবং ভারত বিরোধী নীতির একজন বিশ্বখ্যাত ব্যাক্তিত্ব দরকার বাংলাদেশের জন্য। সারা দুনিয়া যাকে স্যালুট করে। তার ব্যাক্তিত্ব আর পশ্চিমে লবিং এর কাছে ভারতনীতি কিছুই না। উল্টো ভারতও চাইবে তার সাথে সম্পর্ক খারাপ না করে চলতে। একটু অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন ও সরকার গঠনের জন্য তার মতো একজন মানুষের বিকল্প নেই।
আমার মনে হয়, কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলেও, ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর বিকল্প এমন দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তিত্বের নাম কেউ সামনে আনতেও পারবেন না, যার বিশ্বময় প্রভাব ও পরিচিতি আছে। এছাড়া আমাদের অর্থনীতির অবস্থা এই মুহুর্তে খুবই নাজুক। দেশের পুরো অবকাঠামো ভেঙ্গে পরার মতো অবস্থা। ঢেলে সাজাতে হবে পুরো দেশকে। এই অবস্থায় আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা বৈদেশিক (বিশেষত পশ্চিমা) ঋণগুলো ভীষণ দরকারি হবে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে৷ ড. ইউনুস এই জায়গায় বড় একটা প্লাস পয়েন্ট হতে পারেন হয়তো৷
তিনি অল্প সময় দেশের দায়িত্বে থাকবেন। তিনি দেশের অবকাঠামো ও রাষ্ট্র মেরামতের কাজ কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। বিশেষ করে দ্বিতীয় স্বাধীনতায় তারুণ্যের বাংলাদেশ তিনি উপহার দিবেন। তরুণদের চিন্তা ও চাওয়াকে তিনি বাস্তব প্রতিফলন করে ইতিহাস তৈরী করবেন বলে আশা করা যায়। উৎসবের সময় শেষ। এখন সময় শৃঙ্খলার, দেশ গড়ার। আশার কথা, আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে আমি এ বিষয়ে সচেতনতা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।
ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান জাতির প্রয়োজনে সঠিক ভূমিকা নিয়েছেন। আমরা এটি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আবারও ইতিবাচকভাবে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের এখানে একটা নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। এখন ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর দক্ষ ও সঠিক নেতৃত্বে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে, একদল যোগ্য দেশপ্রেমিক মেধাবী চিন্তাশীল নাগরিক এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন বিচার বিভাগ, পুলিশ সিভিল প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, এগুলোকে সংস্কারের ব্যবস্থা করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাওয়া। আর ড. মুহাম্মদ ইউনুস হতে যাচ্ছেন সেই সংকটকালীন বাংলাদেশের কান্ডারী।
আমি আশা করি একটি বৃহত্তম মুসলিম দেশের এমন একটি নাজুক সময়ে তিনি হাল ধরেছেন, উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী হিসাবে দেশের মানুষের ধর্ম বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসার জায়গাটি তিনি দখল করে নিবেন। তিনি চাইলেই এখন, মুসলমানদের সাম্য ভ্রাতৃত্ব ও ইনসাফ ভিত্তিক জীবনধারার তিনি হয়ে উঠতে পারেন জাতীর একজন আস্থাশীল নাবিক। সকল ধর্ম, চিন্তা, মত ও পথের মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা হবে তার প্রথম কাজ। আশা করি, তরুণ প্রজন্ম ও ছাত্রদের স্বপ্নের এক নতুন বাংলাদেশ উপহার দিবেন তিনি।
অভিনন্দন ও দুআ রইল ড. মুহাম্মদ ইউনুস আপনার জন্য…
লেখক: আলেম ও গবেষক
মহাপরিচালক : জাতীয় কওমী শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বাংলাদেশ।